ভোটের হাওয়া: হবিগঞ্জ-২ আওয়ামী লীগে ‘মজিদ হটাও’ বিএনপি ঐক্যবদ্ধ

ভোটের হাওয়া: হবিগঞ্জ-২ আওয়ামী লীগে 'মজিদ হটাও' বিএনপি ঐক্যবদ্ধ

হাওরাঞ্চলের কৃষি ও মৎস্যজীবী অধ্যুষিত হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি দু’বার করে জয় পেলেও আসনটি বরাবরই আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। গত দু’বারের নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান এ আসনে জয় পেয়েছেন। তবে আগামী নির্বাচনে তার মনোনয়ন পাওয়া সহজ নাও হতে পারে। দলের সম্ভাব্য সব প্রার্থী একাট্টা হয়েছেন ‘মজিদ হটাও’ আন্দোলনে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে চায় বিএনপি। মনোনয়ন দৌড়ে বিএনপির একাধিক প্রার্থী মাঠে থাকলেও আখেরে একজনের পেছনেই ছুটবেন তারা। স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমনই আভাস মিলেছে। এ আসনে জাতীয় পার্টিরও রয়েছে ভোটব্যাংক। জোট-মহাজোটের রাজনীতির দেনদরবারে জাতীয় পার্টির শংকর পাল মনোনয়ন পেয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

হবিগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে বর্তমান এমপি অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান ছাড়াও রয়েছেন বানিয়াচং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আমীর হোসেন মাস্টার, জেলা কৃষক লীগের সভাপতি হুমায়ুন কবীর রেজা, সাবেক সচিব ইকবাল খান চৌধুরী, ঢাকা জজকোর্টের এপিপি মাহফুজা বেগম সাঈদা, সাবেক এমপি শরীফ উদ্দিন আহমেদের ছেলে ময়েজ উদ্দিন শরীফ রুয়েল, দলের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক কবি ছাদিকুর রহমান চৌধুরী পরাগ, সাবেক জেলা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট চৌধুরী আবু বকর সিদ্দিকী, সাবেক বিচারক ব্যারিস্টার এনামুল হক এবং যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ।

আবদুল মজিদ খান তার উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরে দৈনিক আগামীর সময় কে বলেন, যে কেউই দলের মনোনয়ন চাইতে পারেন। সে অধিকার সবার আছে। তবে নয় বছর ধরে তিনি বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জের মতো অবহেলিত জনপদে যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিদ্যুতায়নে যে উন্নয়ন করেছেন, তা অভূতপূর্ব। একসময় বর্ষায় দুর্গম ভাটি এলাকায় নৌকা ও শুকনো মৌসুমে হাঁটা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। বর্তমানে প্রতিটি গ্রামের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। কালনী নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণ ছাড়াও দুই উপজেলায় বহু ব্রিজ-কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। জনগণ নিশ্চয়ই এর মূল্যায়ন করবে। নেতাকর্মীরাও তার সঙ্গে রয়েছেন।

দলের বিভক্তির বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে আবদুল মজিদ বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে এমনটা হয়েই থাকে। তবে হাতে গোনা কয়েকজন নেতাকর্মী ছাড়া তৃণমূলের সবাই তার সঙ্গে রয়েছে। দল তাকে মনোনয়ন দিলে আগের মতো আবার নেতাকর্মীরা একজোট হয়ে নৌকা প্রতীকের বিজয়ের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বেন।

আবদুল মজিদ খানের এ বক্তব্য মানতে নারাজ আওয়ামী লীগের আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী আমীর হোসেন মাস্টার। তার অভিযোগ, বতর্মান এমপি দলে বিভক্তি তৈরি করে রেখেছেন। এ কারণে তৃণমূল নেতাকর্মীরা তার ওপর ক্ষুব্ধ। এ অবস্থায় তিনি মনোনয়ন পেলে আসনটি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করায় তাকে ১৮ মাস কারাভোগ করতে হয়েছে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও তিনি জেল খেটেছেন। এসব বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকেই দলের মনোনয়ন দেবেন। সে প্রত্যাশা নিয়েই তিনি এলাকায় গণসংযোগ করে যাচ্ছেন। ভোটারদের কাছ থেকেও বেশ সাড়া পাচ্ছেন।

বানিয়াচং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ইকবাল হুসেন খানের বক্তব্যেও দলের বিভক্তির বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের কারণে দলের নেতাকর্মীরা বর্তমান এমপি আবদুল মজিদ খানকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাই আসনটি ধরে রাখার পাশাপাশি দলীয় ঐক্য ঠিক রাখতে নেতাকর্মীরা আমীর হোসেন মাস্টারের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন।

প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে আছেন জেলা কৃষক লীগ সভাপতি হুমায়ুন কবীর রেজাও। তার বক্তব্যেও অভিন্ন সুর- মজিদ খানের ওপর নেতাকর্মীরা অসন্তুষ্ট। তাকে মনোনয়ন দিলে আসনটি ধরে রাখা কঠিন হবে। তিনি বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে রয়েছেন।

অ্যাডভোকেট মাহফুজা বেগম সাঈদাও এলাকায় গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। দলের প্রতিটি কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন। তার দাবি- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী নেতৃত্ব বিকাশের ঘোষণা দিয়েছেন। এ কারণেই তিনি মনোনয়নের বেলায় অগ্রাধিকার পাবেন।

কবি ছাদিকুর রহমান চৌধুরী পরাগ বলেন, এলাকায় তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার নিবিড় সখ্য রয়েছে। সাধারণ ভোটাররাও তার সঙ্গে রয়েছেন। দল তাকে মনোনয়ন দিলে নিরাশ করবেন না।

অ্যাডভোকেট চৌধুরী আবু বকর সিদ্দিকী বলেন, গত চারটি নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চেয়ে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। নিশ্চয়ই আগামী নির্বাচনে দল তাকে মূল্যায়ন করবে। তার বক্তব্য, তিনি সার্বক্ষণিক মানুষের পাশে থাকছেন।

ব্যারিস্টার এনামুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনোনয়নের বেলায় তরুণ, সুশিক্ষিত, সৎ ও মেধাবীদের গুরুত্ব দেবেন। সে ক্ষেত্রে তিনি এগিয়ে থাকবেন।

ড. মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ মনে করেন, এখন তরুণ নেতৃত্বের সময়। তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি দলের মনোনয়ন পাবেন বলে আশা করছেন।

এদিকে বিএনপিতেও রয়েছে একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী। তবে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (সিলেট বিভাগ) ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবনকে আবারও প্রার্থী করতে পারে হাইকমান্ড। নবম সংসদ নির্বাচনে লড়ে হারলেও আগামী নির্বাচনে তার প্রতিই আস্থা রয়েছে দলের। এমনটাই মনে করছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। ডা. সাখাওয়াত বলেন, এ অঞ্চলে বিএনপির অবস্থান বেশ শক্ত। দলে কোনো গ্রুপিং নেই। মানুষও বিএনপিকে চাইছে। বানিয়াচং উপজেলা নির্বাচনের ফসল বিএনপির ঘরে এসেছে। আগামী সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হলে অবশ্যই বিএনপির প্রার্থী জয়ী হবেন।

বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকায় আরও রয়েছেন দলের জেলা সহসভাপতি অ্যাডভোকেট মঞ্জুর উদ্দিন আহমেদ শাহীন ও সৌদি আরব পশ্চিমাঞ্চল শাখার সভাপতি আহমদ আবদুল্লাহ মুকিব। মঞ্জুর উদ্দিন আহমেদ শাহীন বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই তিনি এলাকার মানুষের স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছেন। তৃণমূল পর্যায়ে দলকে সংগঠিত করার জন্য পরিশ্রম করছেন। তাই দল তাকে মূল্যায়ন করবে বলে তার বিশ্বাস।

আহমদ মুকিব আবদুল্লাহ জানান, তার রাজনীতি পুরো মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের নেতাকর্মীদের নিয়ে। তার প্রত্যাশা, দল তাকে মনোনয়ন দেওয়ার ব্যাপারে এগুলো বিবেচনা করবে। তবে প্রার্থী যেই হোক- তাকে বিজয়ী করতে বিএনপির সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবে।

হবিগঞ্জ জেলা জাতীয় পার্টির সদস্য সচিব শংকর পালও নড়েচড়ে বসেছেন। গত নির্বাচনে তিনি অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে হেরেছেন। তার দাবি, এবার আওয়ামী লীগের ভোটে ভাটা পড়েছে। এবার তিনি মনোনয়ন পেলে অবশ্যই জয় পাবেন। তবে সবকিছু নির্ভর করছে জোটগত রাজনীতির ওপর।

এ ছাড়া এই আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী, খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদ, জেলা ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক মাওলানা লুৎফুর রহমান চৌধুরী আজাদ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী সাংবাদিক আফসার আহমেদ রূপক।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment